তামিম মজিদ,শাবি
সিলেটনিউজ২৪.কম
দেশের প্রথম এবং একমাত্র এ বিভাগটির মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টিমান নিয়ন্ত্রন ও সুষম খাবার উৎপাদন এবং চা শিল্পের উন্নয়নে এখানে জন্ম নিচ্ছে দক্ষ প্রকৌশলী ও গবেষক ।
খাদ্য ও চা শিল্পের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরীর কারখানা হচ্ছে এফটিটি বিভাগ। সুষম খাদ্য নিয়ে যথাযথ গবেষণা ও পুষ্টিমানের নিয়ন্ত্রণে দক্ষ জনশক্তির অভাবই এ পুষ্টিহীণতার অন্যতম কারন। পুষ্টিহীণতায় ভোগা জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
গোড়ার কথা :দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ সিলেট। চায়ের মাতৃভূমি নামে যা সর্বাধিক পরিচিত। আবার চায়ের রাজধানীও বলা হয়ে থাকে সিলেটকে। যাই বলা হয়ে থাকে না কেন, চা উৎপাদন ও চা শিল্পের বিকাশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে প্রথম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সালে ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের অধীনে ‘টি টেকনোলজি’ নামে এই বিভাগ যাত্রা শুরু করে।
২০০৪-০৫ সেশনে বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে প্রথম শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এরপর যুগের চাহিদার সাথে কর্মক্ষেত্র প্রসার ও খাদ্য শিল্পে দক্ষ মানব সম্পদ যোগানের লক্ষ্যে ২০০৫-০৬ সেশনে বিভাগটির নাম পরিবর্তন করে ‘ফুড এ্যান্ড টি টেকনোলজি’ বিভাগ নামধারণ করে।
অবশেষে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ‘ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টি টেকনোলজি’ বিভাগ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রকৌশল বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। নতুন বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা ও কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ইতোমধ্যে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহের বিষয় হিসেবে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে।
কি পড়ানো হয়:বর্তমান প্রেিযাগীতামূলক বিশ্বে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যেখানে মেডিক্যাল সায়েন্স, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং,কম্পিউটার সায়েন্স, ব্যবসায় শিক্ষা কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, সেখানে এ ধারার বাইরে বর্তমান বিশ্বে চাহিদাসম্পন্ন বিষয় হিসেবে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টি টেকনোলজি আলাদা একটি অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগের স্বল্পসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীই এই বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকে।
২০০৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এ বিভাগে বর্তমানে ৬টি ব্যাচে মোট ১২৮ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এ বিভাগের ৩০টি আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। খাদ্য ও চা শিল্পের উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের দক্ষ প্রকৌশলী এবং গবেষক হিসেবে গড়ে তুলতে এ বিভাগের আওতায় পড়ানো হয় ফুড প্রিন্সিপ্যাল অফ ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড প্রসেসিং এ্যান্ড প্রিজারভেশন, সেফটি এ্যান্ড সেনিটেশন অফ ফুড ইন্ডাস্ট্রি, ইউনিট অপারেশন অফ ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইন ফুড এ্যান্ড টি ইন্ডাস্ট্রি, টি ফিজিওলজি, এ্যাগ্রো টেকনোলজি অফ টি, জেনেটিক্স এ্যান্ড টি ব্রিডিং, টি ম্যানুফেকচারিং এ্যান্ড প্যাকেজিং, এ্যানটোলজি এ্যান্ড প¬্যান্ট প্যাথোলজি অফ টিসহ মোট ১৬২ ক্রেডিটের নানা বিষয়।
ল্যাব ও লাইব্রেরি সুবিধা : মানসম্পন্ন বিভাগ ও ল্যাব সরঞ্জাম অত্যন্ত দামি হওয়ায় এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকৌশল বিভাগের ল্যাব ব্যবহার করে থাকেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ টি রিসার্স ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও এ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের ল্যাবেও তারা গবেষণা করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত নানা ফুড ইন্ডাস্ট্রিতেও শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক প্রোজেক্ট ওয়ার্ক করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ‘ই’ তে বিভাগের ল্যাবের সম্প্রসারণ ও নতুন গবেষণা যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। খাদ্য এবং চা-য়ে মেক্সিমাম রেসিডিউ লিমিট পরিমাপের জন্য শিক্ষার্থীদের ‘গ্যাস লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি’ (জিএলসি) এবং হাই পারফরমেন্স লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি’ (এইচপিএলসি) মেশিন ব্যবহার শেখানো হয়। আর এর ফলে খাদ্য ও চা শিল্পের ভবিষ্যত প্রকৌশলীরা নিজেদের আরও দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারছেন। ল্যাব ব্যবহারের পাশাপাশি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় লাইব্রেরী এবং বিভাগের নিজস্ব সেমিনার কক্ষে রয়েছে পর্যাপ্ত বই এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধের এক বিশাল সংগ্রহ।
কর্মক্ষেত্র : বাংলাদেশে প্রথম ও একমাত্র ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগটি নতুন সৃষ্টি হওয়ায় অনেক জায়গায় এর কর্মক্ষেত্র রয়েছে। বিভিন্ন চা এস্টেট ও খাদ্য শিল্প এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের মূল কর্মক্ষেত্র। প্রকৌশল ডিগ্রি থাকায় খাদ্য ও চা শিল্পে এফইটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। এছাড়া চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবেও এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে।
শিক্ষার্থীদের কথা : সুনামগঞ্জের ছেলে নাসিম। এখন তিনি পড়েন ২য় বর্ষ ২য় সেমিস্টারে। স্বপ্ন দেখেন মেধাসম্পন্ন স্বনির্ভর এক বাংলাদেশের। ভর্তি হোন শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগে। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই এমন একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে ভর্তি হোন তিনি। কথা হলো তার সাথে। "আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে।
খাদ্য ও চা শিল্পের উন্নয়নে কিছুদিনের মধ্যেই সত্যিকারের একজন প্রকৌশলী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করব" স্রেফ এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা জানালেন তিনি। ক্লাস-পরীক্ষা আর ল্যাব নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে এফইটি বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী কাজী সুমাইয়ার। এরই ফাঁকে স্বপ্ন দেখেন বড় গবেষক হয়ে খাদ্য মানোন্নয়নে নানা গবেষণা করবেন তিনি। কাজ করবেন বিশ্বের স্বনামধন্য খাদ্য গবেষণাগার বা কোয়ালিটি কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানে। স্বপ্ন দেখেন পরনির্ভরশীলতা ও পুষ্টিহীণতার হাত থেকে নিজ দেশকে রক্ষার। তাদের মত স্বপ্ন দেখেন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরাও।
বিভাগীয় প্রধানের কথা : ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, খাদ্য ও চা শিল্পের উন্নয়নে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরীতে শাবি’র ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগটি বিশেষ অবদান রাখছে। ইতোমধ্যে চায়ের গুনগত মানোন্নয়ন ও বিভিন্ন অপ্রচলিত খাদ্য এবং তার পুষ্টিমান নিয়ে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে সফলতা এসেছে। তাই এই বিভাগের উন্নয়নে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
তিনি জানান, এই বিভাগ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা একজনও বসে নেই। সুষম খাবার উৎপাদন এবং চা শিল্পে এ বিভাগ থেকে পাশ করা প্রকৌশলীরা সুনামের সাথে কাজ করছেন। শিক্ষার্থীদের সত্যিকার অর্থে দক্ষ মানবসম্পদে রুপান্তর করতে বিভাগটির গবেষণাগারে আরও আধুনিক গবেষণা সরঞ্জাম সংযোজন এবং বিষয় ভিত্তিক বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো উচিৎ বলে তিনিমন্তব্য করেন।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন